যে কারণে কমছে নদীর পানিপ্রবাহ
গত তিন দশকে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর পানিপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে বেশিরভাগ নদীই বর্ষা ও বর্ষার আগে-পরে পানিপ্রবাহের হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর পানিপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে বেশিরভাগ নদীই বর্ষা ও বর্ষার আগে-পরে পানিপ্রবাহের হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে।
এছাড়া, নদীর ওপর বাঁধসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কারণে একদিকে মাছের প্রজাতি সংকট দেখা দিয়েছে, অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
গবেষণাটি ১০টি প্রধান নদী নিয়ে করা হয়েছে, যার মধ্যে গঙ্গা (শুকনো মৌসুমে), গড়াই, হালদা এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি নিরাপদ সীমা পেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে, আরও ছয়টি নদী "সতর্কতা" অবস্থায় রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পদ্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীর ক্ষেত্রে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে শুকনো মৌসুমে ন্যূনতম পানিপ্রবাহ সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। একইসঙ্গে, ন্যূনতম পানি প্রবাহ না থাকা বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার "ক্ষতিকারক প্রভাব" দেশের বিভিন্ন নদী অববাহিকায় স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।
নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণ কী?
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী আন্তঃসীমান্ত হওয়ায় প্রায় ৮০ শতাংশ পানি অন্য দেশ থেকে আসে। ফলে, ভারত বা চীনে নির্মিত সেতু, বাঁধ বা অন্যান্য কাঠামো পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়া, দেশের অভ্যন্তরীণ খাল, পুকুর ভরাট করাও নদীর সঙ্গে সংযোগ নষ্ট করে এবং পানির প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
অধ্যাপক সারওয়ার হোসেন বলেন, "পানি নিরাপত্তার সঙ্গে এসডিজি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য সমস্যার আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। এসব সমস্যা আলাদাভাবে সমাধান না করে, একত্রে সমন্বিতভাবে সোশ্যাল ইকোলজিক্যাল সিস্টেম অ্যাপ্রোচ প্রয়োগ করা জরুরি।" তিনি আরও বলেন, "যদি সমন্বিত সমাধান না বের করা হয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়।"
আরেক গবেষক আলমগীর কবির জানান, "প্রতিটি নদী এখন অনিরাপদ। বিশেষ করে পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকার পরও আমরা উজান থেকে প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছি না।"
নদীতে ন্যূনতম পানি কমে গেলে কী ক্ষতি হয়?
নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকলে মাছের প্রজননস্থল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগে নদীই কৃষির জন্য প্রধান পানির উৎস ছিল, তবে বর্তমানে পানি কমে যাওয়ায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে, কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, এবং তারা স্বনির্ভর হতে পারছে না। পাশাপাশি, ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পানির লবণাক্ততা বেড়েছে।
মো. সারওয়ার হোসেন বলেন, "উজান থেকে আসা মিঠা পানি এবং সাগরের লবণাক্ত পানির মিশ্রণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট একটি ইউনিক ইকোসিস্টেম তৈরি হয়। কিন্তু, মিঠা পানি না আসলে, সাগরের লবণাক্ত পানি বাড়বে, যার ফলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ভারসাম্য নষ্ট হবে।"
এছাড়া, হিমালয় থেকে আসা পানির সঙ্গে প্রচুর পলি জমে, যা বাংলাদেশের ডেল্টা বা ব-দ্বীপ তৈরি করে। কিন্তু, পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি জমতে জমতে নদীর ধারণক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে বর্ষা বা বর্ষা পরবর্তী সময়ে বন্যা হতে পারে।
সারওয়ার হোসেন আরও বলেন, "পদ্মা নদীর পূর্বের মাইটি রিভার বৈশিষ্ট্য এখন আর নেই। পানি নিরাপদ সীমার বাইরে থাকায় এটি বাস্তব প্রভাব ফেলছে।"
এছাড়া, গঙ্গার নিচের অংশ এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতে মাছের প্রজাতির বৈচিত্র্যও কমে গেছে। গঙ্গার উজানে ইলিশসহ অনেক মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পরিবেশগত কারণে, হালদা নদীর অবস্থাও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক কার্প জাতীয় মাছের প্রজননস্থল, কিন্তু নদীটিতে মাছের আবাস ও প্রজনন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অধ্যাপক সারওয়ার হোসেন বলেন, "সোশিও-ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের ক্ষতি হলে, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। শুধু আমরা নয়, উজানের মানুষও ধীরে ধীরে ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
What's Your Reaction?