চাঁদা না দিলে ‘স্বৈরাচারের সহযোগী’ অভিযোগে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি

রাজশাহীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া কিংবা মামলার আসামি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে এরা। এমনকি থানা পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে হানা দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও। তাদের হাতে হেনস্তা হচ্ছেন এমন লোকজন, যাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই।

Dec 17, 2024 - 04:33
 0  6
চাঁদা না দিলে ‘স্বৈরাচারের সহযোগী’ অভিযোগে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি

রাজশাহীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। রাজনৈতিক ট্যাগ লাগিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া কিংবা মামলার আসামি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে এরা। এমনকি থানা পুলিশসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে হানা দিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছে কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও। তাদের হাতে হেনস্তা হচ্ছেন এমন লোকজন, যাদের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই।

এদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজশাহীতে পরিস্থিতি এখন খুবই ভয়াবহ। এসব কিশোর গ্যাং নিজেদেরকে কখনো রাজনৈতিক দলের কর্মী, কখনো ডিবি পুলিশের পরিচয় দিচ্ছে। ফোন করে বিকাশে টাকা দাবি করছে। ভোরে লোকজনের বাড়ির দরজায় দলবেঁধে গিয়ে কড়া নাড়ছে টাকার জন্য। পুলিশের অনেকেই নিজেরাই ভুক্তভোগী হওয়ায় লোকজনের অভিযোগ পেয়েও কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস করছেন না। আবার কোনো প্রতিকার পাবেন না ভেবে অনেক ভুক্তভোগীও পুলিশে অভিযোগ দিচ্ছেন না।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরী ও জেলার গোদাগাড়ী ও পবা এলাকাজুড়ে বেপরোয়া কিশোর গ্যাঙের তৎপরতা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পট পরিবর্তনের পর থেকে পাড়া-মহল্লায় নতুন করে গজিয়ে উঠেছে এইসব কিশোর গ্যাং। এদের অনেকেই মাদকাসক্ত ও দলবেঁধে মাদক সেবন করে। এসব কিশোর গ্যাঙের কবলে পড়ে প্রতিদিনই কেউ না কেউ টাকা-পয়সা খোয়াচ্ছেন। কেউ নাজেহাল হচ্ছেন পথ চলতে গিয়ে।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা অনেকেই ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার প্রয়োজনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন। গত ৫ আগস্টের পর অনেকেই স্থানীয় ঝুট-ঝামেলা এড়াতে পরিবার নিয়ে নগরীতে গিয়ে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছেন। অপরিচিত এসব পরিবারের কেউ না কেউ আক্রান্ত হয়েছেন কিশোর গ্যাঙের হাতে।

জানা গেছে, গত নভেম্বরের শেষে নগরীর তেরখাদিয়া ডাবতলা এলাকায় কিশোর গ্যাঙের কবলে পড়েন প্রেমতলীর নয়ন মেম্বার। কিশোর গ্যাঙের দলটি তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না পেলে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে পুলিশে সোপর্দের ভয় দেখানো হয়। ঘটনা জানতে পেরে পরিচিত লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কিশোর গ্যাঙের সঙ্গে ৫০ হাজার টাকায় রফাদফা করেন। নয়ন মেম্বার জানিয়েছেন তার বিরুদ্ধে দেশের কোথাও কোনো মামলা নেই। তিনি আরও বলেন, যারা তাকে ধরেছিল তারা নিজেদের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী পরিচয়ে ধরেছিল।

নগরীর বিভাগীয় স্টেডিয়াম এলাকায় বসবাসকারী একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তেরখাদিয়া ও ডাবতলা এলাকায় বাইরে থেকে আসা লোকজনের বসবাস বেশি। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কিশোর-যুবকদের কয়েকটি দল সংঘবদ্ধভাবে এসব এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। রাস্তায় অপরিচিত কাউকে দেখলেই পুলিশের মতো জেরা করে। কখনো কখনো তাদের আটকে রাখে। দাবিকৃত টাকা-পয়সা না দিলে স্বৈরাচারের দোসর বলে ট্যাগ লাগিয়ে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দের ভয় দেখাচ্ছে। অনেকেই ঝামেলা এড়াতে টাকা-পয়সা দিয়ে রফাদফা করে ছাড়া পাচ্ছেন।

গোদাগাড়ীর বিদিরপুর এলাকার একজন কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তিনি কখনো কোনো দল করেননি। গত ৫ আগস্টের পরও সবকিছু স্বাভাবিক কেটেছে। সম্প্রতি তাকে বারবার ফোন করে টাকা দাবি করা হচ্ছে। টাকা না দিলে ডিবি পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিয়ে জেলে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি একজন পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘটনা জানিয়ে পরামর্শ চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে ফোন বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। শনিবার রাতে একটি দল বাড়ির দরজায় টোকা দিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি এরা কিশোর গ্যাং। মাদকের টাকা জোগাড়ে তাদের এই বেপরোয়া ছোটাছুটি। তাদেরকে বলার মতো কোনো নেতাও নেই এলাকায়। রাজশাহীর কোর্ট এলাকার ব্যবসায়ী সেতাবুর রহমান বলেন, আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করি। এখন দেখছি নতুন উপদ্রব। পরিচিত অপরিচিত কিশোর তরুণরা দল বেঁধে এসে টাকা-পয়সা দাবি করছে। আগে মহল্লাতে এরা কিশোর গ্যাং হিসাবে পরিচিতি ছিল। এখন বলছে তারা ওমুক ভাইয়ের লোক। ওমুক দলের নেতা। রাজশাহীর একজন দলিল লেখক অভিযোগে বলেন, ক’দিন আগে একাধিক নম্বর থেকে ফোন করে তার কাছে টাকা দাবি করা হয়েছে। টাকা না পেলে মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সদর উপজেলা পরিষদের একটি দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অফিস সময় হলেই চার পাঁচজন করে দলবদ্ধভাবে এসে হাজির হচ্ছে। বয়সে তারা তরুণ ও কিশোর। তাদের কাউকে শিক্ষার্থী বলে মনেও হয় না। এসে নানা ধরনের দাবি। তাদের প্রত্যেককে ১০টা করে ভিজিডি কার্ড দিতে হবে। আমরা তাদেরকে কার্ড দেব কীভাবে। কারণ কাউকে কার্ড দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, ভুক্তভোগী কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কেউ চাইলে গোপনেও তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করতেন পারেন। সেক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow