ইউরোপের পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের আত্মাহুতি
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক সুখবর প্রচারিত হচ্ছে—বাংলাদেশের বাগেরহাটে তৈরি কাঠের ঘর ইউরোপের বেলজিয়ামে রপ্তানি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন এসব কাঠের ঘরের চাহিদা ইউরোপে বাড়ছে, যা পূরণের সুযোগ পেয়েছে একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এক সুখবর প্রচারিত হচ্ছে—বাংলাদেশের বাগেরহাটে তৈরি কাঠের ঘর ইউরোপের বেলজিয়ামে রপ্তানি হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন এসব কাঠের ঘরের চাহিদা ইউরোপে বাড়ছে, যা পূরণের সুযোগ পেয়েছে একটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, ব্রিটেন, ভিয়েতনামসহ আরও কিছু দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই কাজটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে। বাংলাদেশে তৈরি এসব কাঠের ঘর ইউরোপে বসানোর কাজ করবেন দেশীয় কারিগররাই। এটি দেশের রপ্তানি বাজারের জন্য একটি বিশেষ অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অনেকেই মনে করছেন, এই ঘর রপ্তানি নতুন বাজার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি করবে। উদ্যোক্তারা বলছেন, এই উদ্যোগে দেশের কারিগররা ইউরোপে কাজের সুযোগ পাবেন, উপকরণগুলো পরিবেশবান্ধব ও বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ায় এই ঘরগুলো পরিবেশ সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
তবে এখানেই একটি পরিবেশসচেতন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন ওঠে—আমাদের ক্রমহ্রাসমান বৃক্ষসম্পদ ব্যবহার করে কেন ইউরোপের পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরি করা উচিত? যেখানে বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ ক্রমেই কমছে এবং পরিবেশের বিরূপ প্রভাব দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে, সেখানে আমাদের গাছ কেটে অন্য দেশের পরিবেশ রক্ষা কতটা যৌক্তিক?
ইতিপূর্বে ক্রোয়েশিয়া ও বুলগেরিয়া কাঠের ঘর রপ্তানি করত, তবে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য তারা এই কাজ বন্ধ করেছে। ফলে ইউরোপকে পরিবেশবান্ধব করতে বাংলাদেশের ওপরই এই দায়িত্ব এসে পড়েছে। তবে উল্লেখ্য, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া এখনও এই ধরনের ঘর ইউরোপে রপ্তানি করছে।
বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৬ শতাংশ (বাস্তবে এর পরিমাণ আরও কম হতে পারে), যেখানে ক্রোয়েশিয়ার বনভূমি দেশটির মোট আয়তনের ৩৪ শতাংশ, বুলগেরিয়ার ৩৬ শতাংশ, লিথুয়ানিয়ার ৩৪ শতাংশ এবং এস্তোনিয়ার ৫২ শতাংশ। এই তুলনায় আমাদের বনজ সম্পদ ইউরোপের পরিবেশবান্ধব ঘর তৈরির জন্য ব্যবহার করা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের দেশে বনভূমির অপ্রতুল পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে অবৈধ গাছ কাটা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বসতি স্থাপন, শিল্পায়ন, অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাণিজ্যিক বনায়নের কারণে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বনজ সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার ও বাণিজ্যিক চাপে কাঠ, জ্বালানি কাঠ, বাঁশ, বেত এবং পশুখাদ্যেরও অভাব দেখা দিচ্ছে।
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দেশে ২০ লাখ হেক্টরের বেশি প্রাকৃতিক বনভূমি ছিল, যা থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর হারিয়ে গেছে। অন্য এক হিসাবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। প্রাকৃতিক বনকে সংকুচিত করে সেখানে পরিবেশবান্ধব নয়, এমন বিদেশি প্রজাতির ইউক্যালিপটাস ও একাশিয়ার মতো গাছ লাগানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) তথ্য অনুসারে, ১৯৭৩ সালে মধুপুর জঙ্গলে ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর শালবন ছিল। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ হাজার ৭০০ হেক্টরে, বাকিটায় লাগানো হয়েছে একাশিয়া, রাবার, আনারস, কলা, পেঁপে, লেবু, হলুদসহ বিভিন্ন মসলার গাছ।
বন উজাড় করে এমন কৃত্রিম বনায়ন পরিবেশ ও ইকোসিস্টেমের মারাত্মক ক্ষতি করছে। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে কিছু বৃক্ষরোপণ হলেও তা প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের তুলনায় অপ্রতুল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে শিমুল আলু বা কাসাভার চাষের জন্য শত শত একর বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফসলের কারণে মাটি ক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে। এতে কমে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী, পাখি, পোকামাকড় ও সরীসৃপের আবাসস্থল।
পরিবেশের এই ক্রমাগত অবনমনের মাঝে ইউরোপে পরিবেশবান্ধব কাঠের ঘর রপ্তানির মাধ্যমে দেশের বনজ সম্পদ ব্যবহার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা খুব একটা দেখা যায় না। এমন পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রমকে উৎসাহ দেওয়ার বিষয় দেখে ধারণা করা যায়, দেশে পরিবেশ সচেতন মানুষের সংখ্যা এখনও অপ্রতুল।
What's Your Reaction?