বিচার বিভাগের সংস্কার ও জনক্ষমতায়ন

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সমস্যাগুলো সাধারণত ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, মামলাজট, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নিয়মাবলি না থাকা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত রাখা—এসব বিষয়ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়ন না করার ফল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কারণে, বিচার বিভাগীয় সংস্কারের যেকোনো প্রস্তাব বা ফর্মুলা একরৈখিক সমাধানের দিকে ঠেলে দেয়।

Nov 5, 2024 - 10:01
 0  1
বিচার বিভাগের সংস্কার ও জনক্ষমতায়ন
আইনের মাধ্যমেই স্বৈরাচারী সরকারগুলো জনগণের ক্ষমতাকে সংকুচিত করে ‘পোষ মানানো’ প্রাণীতে রূপান্তর করে। ৩০ জুলাই ২০২৪ l

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সমস্যাগুলো সাধারণত ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, মামলাজট, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নিয়মাবলি না থাকা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নির্বাহী বিভাগের হাতে কেন্দ্রীভূত রাখা—এসব বিষয়ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়ন না করার ফল হিসেবে বিবেচিত হয়। এই কারণে, বিচার বিভাগীয় সংস্কারের যেকোনো প্রস্তাব বা ফর্মুলা একরৈখিক সমাধানের দিকে ঠেলে দেয়।

জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর থেকে আমরা শুনতে পাচ্ছি যে মাসদার হোসেন মামলার (১৯৯৯) রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলেই জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে। যদি একটি পৃথক সচিবালয় গঠন করা হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের বাজেটের উপর নিয়ন্ত্রণ আসবে, অধস্তন আদালতে পর্যাপ্ত বিচারকের নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহজ হবে, দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে এবং ই-জুডিশিয়ারির মতো প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো গ্রহণ সহজ হবে।

এসব কার্যকরী সমাধানের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা সংস্কারের মৌলিক দার্শনিক প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। কারণ, আইনগত বিচারিক সংস্কারের বিষয়টি মূলত জনগণের ক্ষমতায়নের বিষয়। আধুনিক রাষ্ট্রে আইনই জনগণকে ক্ষমতায়িত করে, অথবা ক্ষমতাকে সংকুচিত করে 'পোষ মানানো' প্রাণীতে পরিণত করে।

রাশেদ রাহম

আমাদের ইতিহাসে জনগণকে কীভাবে ক্ষমতাহীন ও নিষ্ক্রিয় একটি জড়বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এবং বিচার বিভাগের ভূমিকা কী ছিল, তা বোঝা প্রয়োজন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের প্রভাবই ছিল প্রধান। স্থানীয়ভাবে বিচারিক কাঠামো থাকলেও তার ব্যাপ্তি ছিল সীমিত। অন্যদিকে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতের জনগণ ও সম্পদকে শোষণ করা। তাই খাজনা আদায়ের জন্য একটি বিস্তৃত আইনগত কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল।

১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়, যা ছিল মানুষের জীবনে আইনশৃঙ্খলা আরোপের একটি কৌশল। যখন জনগণ জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তখন তাদেরকে 'অপরাধী' হিসাবে চিহ্নিত করে ফৌজদারি আইনের আওতায় আনা হত। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে আইনি কাঠামোকে আরও বিস্তৃত করা হয়, আইনগুলো কোডিফায়েড করা হয়, এবং ব্যক্তিগত আইন হিসেবে পরিবার ও ধর্মীয় জীবনে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। আইন কেবল বলপ্রয়োগের একটি হাতিয়ার ছিল না, বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বৈধতার ভিত্তি হিসেবেও কাজ করেছিল।

এভাবে তৈরি হওয়া আইনি কাঠামোর মধ্যে ‘দ্য গুড লিগ্যাল সাবজেক্ট’ এবং অপরাধীদের মধ্যে অন্তর্নিহিত বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। ইংরেজি-শিক্ষিত আইনজীবী ও উকিলরা ছিলেন ‘অবিচারের বাজারে’ বড় সওদাগর। তাদের কাজ ছিল স্থানীয় কৃষকদের পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করে অর্থ উপার্জন করা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পর পূর্ববঙ্গে স্বতন্ত্র হাইকোর্ট স্থাপনের দাবির বিরুদ্ধে কলকাতার উকিলদের প্রতিবাদ উঠে, কারণ এতে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বাংলাদেশের আইনগত কাঠামোতে বিচারকেরা ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়মুক্তি ভোগ করেন। আইন বিভাগ বা সংসদ আইন প্রণয়ন করে, নির্বাহী বিভাগ তা কার্যকর করে। যদি সংসদীয় আইন বা সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাংবিধানিক অধিকারের বিরোধ ঘটে, তাহলে সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করতে পারে। তবে, বিচার বিভাগের কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে জনগণের অংশগ্রহণ বা নজরদারি নেই। এর ফলে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, যা কখনো কখনো ‘জুরিস্টোক্র্যাসি’ বা বিচারকদের স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়।

ইতিহাসে বিচার বিভাগ নির্বাহী নিয়ন্ত্রণের কারণে দমে গেছে। আমাদের প্রশ্ন, কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আজকে সংকটাপন্ন হচ্ছে? উত্তর হল, না। কারণ, বিচারকেরা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দায়মুক্ত পেশাজীবী শ্রেণি। আমরা কি বিচারকদের ভূমিকা নিয়ে কোন রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করেছি?

অনেকে বলেন, বিচার বিভাগের পূর্ণ পৃথকীকরণ না হলে এর কার্যকারিতা বাড়বে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, পৃথক সচিবালয় গঠিত হলে কি সমস্যা সমাধানের নিশ্চয়তা থাকবে? আমলাতন্ত্রের সংস্কৃতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন, অন্যথায় বিচার বিভাগের ক্ষমতা বাড়লে তা বিপজ্জনক হতে পারে।

মামলাজটের সমস্যা কি নতুন বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে সমাধান হবে? মামলাজট একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যা ঔপনিবেশিক সময় থেকেই চলে আসছে।

বর্তমানে আমাদের সামনে একমাত্র উপায় হচ্ছে আইনি কাঠামোর বি-উপনিবেশায়ন, বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ। এজন্য সামাজিক মর্যাদা ও কর্তাসত্তার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। সব সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রের আস্থায় না খুঁজে সমাজের কাছে ফিরে যেতে হবে।

বর্তমানে আমরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে তা করার চেষ্টা করছি, তবে বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক আড়ষ্টতা ও জনগণের ক্ষমতায়নের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারিক সংস্কারের প্রশ্ন মোকাবিলা করার ব্যর্থতার কারণে তা সফল হচ্ছে না।

বিচার বিভাগের গহীনে পৌঁছাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর মাধ্যমে সমাজে সমাধান খুঁজতে হবে। আমাদের অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন, যাতে জনগণের অংশগ্রহণ থাকে এবং প্রশাসনকে জনগণের সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়। রাষ্ট্রের উপর জনগণের কার্যকর জবাবদিহি ও মানবিক মর্যাদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একমাত্র উপায়।

  • রাশেদ রাহম: আইনের ইতিহাস গবেষক

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow