মেসি নামের আনন্দ–কলস
গোলটা করেছিলেন মার্তিনেজ। মেসি ছিলেন গোলের উৎস। কিন্তু মার্তিনেজ আঙুল তুলে যেন বুঝিয়ে দিলেন গোলটি মেসিরই। মার্তিনেজ শুধু আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন
তত দিনে ক্লাব ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সব শিরোপাই জিতেছেন। আকাশি-সাদায় ধরা দিল মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা কোপা আমেরিকাও। তবু লিওনেল মেসির চাওয়ার কানা অপূর্ণ ছিল। বিশ্বকাপ যে জেতা হয়নি। কবির সুমনের ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবি-দাওয়া/এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া’—লাইনের অন্তর্নিহিত গলি-উপগলি দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মেসির সেই অপূর্ণতাও পূরণ হলো কাতারে। তারপর কি মেসির আর কিছু চাওয়ার থাকে?
থাকতে পারে না, কিন্তু ছিল। মেসি আরও কিছুদিন ফুটবল খেলতে চেয়েছিলেন। যত দিন মন চায়। যত দিন বল পায়ে দৌড়ানোর আনন্দ অবশিষ্ট থাকে তত দিন। তাতে লাভ হয়েছে আর্জেন্টিনারই। বিশ্বকাপ জয়ের পর কোপার শিরোপাটা ধরে রাখা গেছে। কিন্তু সে তো বস্তুগত সাফল্য। ফুটবলের সীমানা তো শুধু এতটুকু গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বল পায়ে মেসির দৌড়ানো দেখে পৃথিবীর আনাচকানাচের মানুষের মনের মধ্যে যে অনুভূতি জাগে, যে শিশুসুলভ আনন্দে মনটা আরও পরিশুদ্ধ হয়—সেই সীমানা কি বেঁধে দেওয়া সম্ভব? মেসি এখন সেই অসীম আনন্দের সীমানারই শেষ বিন্দুতে—একেকটি ম্যাচে সে বিন্দু যখন সূর্য হয়ে জ্বলে ওঠে তখন মনের ঈশান কোণে একটি ঘণ্টাও বেজে ওঠে—আর বেশি দিন হয়তো তাঁকে দেখা যাবে না!
সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো, ওসব দুঃখবিলাসে না মজে মাঠে আর যে কদিন তাঁকে দেখার সুযোগ মেলে, চোখ দুটো বিছিয়ে আনন্দের কলস ভরে নেওয়া। বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে আজ সবাই তেমন মানসিকতায় ছিলেন না। বার্তা সংস্থা এএফপি যেমন জানিয়েছে, মেসির দ্বিতীয় গোলটি দেখে গ্যালারির কেউ কেউ চোখ মুছেছেন। তা যেমন আনন্দাশ্রু হতে পারে তেমনি মেসির সোনালি দিনগুলো মনে পড়ে নষ্টালজিক অশ্রু হওয়াও অসম্ভব না।
তবে মেসির নিশ্বাস দূরত্বে থাকা মানুষগুলো কিন্তু এমন নয়। সম্ভবত মেসি তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যাওয়াতে ভক্তদের মতো আলাদা করে এসব আবেগ এখনো ছুঁয়ে যায়নি। মনুমেন্তালে ‘ফাইভ স্টার’ মেসিকে দেখে যেমন ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন আন্তোনেল্লা রোকুজ্জো। সেখানে থিয়াগো, মাতেও অথবা চিরোর মধ্যে কেউ একজন মেসির গোলের পর বলেছে, ‘বাবা গোল করলে ভালোই লাগে।’
জীবনসঙ্গী হিসেবে রোকুজ্জোর কেমন লাগে, সেই প্রশ্নের উত্তর জানেন শুধু মেসি। তবে আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ জানিয়েছে, ঘরে টিভিতে মেসির খেলা দেখে রোকুজ্জো রীতিমতো উল্লাস করেছেন। যদিও এ এমন কিছু ছিল না। ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ, যেখানে আর্জেন্টিনা জিতেছে ৬-০ গোলে। মেসি করেছেন হ্যাটট্রিক, বাকি তিন গোলের দুটিতেও তাঁর অবদান। রোকুজ্জো মেসির ক্যারিয়ারে এমন অনেক হ্যাটট্রিকের চাক্ষুষ সাক্ষী। দেখতে দেখতে তাঁর চোখ পচে যাওয়ার কথা!
কিন্তু চাহনিটা ভালোবাসার হলে প্রতিবারই প্রথম দেখার অনুভূতি জাগে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেসির অসংখ্য ভক্তের মতো রোকুজ্জোর মনও এই জায়গায় সম্ভবত একই মোহনায় মিলেছে। পার্থক্য হলো, ভক্তরা মেসিকে দেখে গত কয়েক বছর ধরে যে কথাটা বারবার বলছেন, রোকুজ্জো সে কথাটাই বললেন মেসির সঙ্গে শৈশবের পরিচয় থেকে একদম ঘর-সংসার করে তাঁকে প্রতি পরতে পরতে চিনে নেওয়ার পর। ইনস্টাগ্রামে রোকুজ্জো তাঁর স্বামীকে নিয়ে লিখেছেন, ‘সর্বকালের সেরা।’
রোজারিওর মেয়েটির দাবি ঠিক না ভুল তা নির্ণয়ের দায়িত্ব সময় ও ইতিহাসের। রক্তমাংসের মানুষ শুধু পারেন মেসিকে দু চোখ ভরে দেখতে। মনুমেন্তালের গ্যালারিতে নিশ্চয়ই এমন মানুষেরাও ছিলেন, ২০০৯ সালে লা পাজের সেই উচ্চতায় এই বলিভিয়ার কাছেই আর্জেন্টিনার ৬-১ গোলের সেই হার দেখেছেন। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের সেই ম্যাচে বলিভিয়া স্ট্রাইকার হোয়াকিন বোতেরোর হ্যাটট্রিক ও সতীর্থদের দিয়ে আরও ২টি গোল করানো দেখে আর্জেন্টাইন ভক্তদের যদি বুক পুড়ে থাকে, তবে ১৫ বছর পর মেসিকে দেখে তাঁদের বুক জুড়িয়েছে। সেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে মেসিও যে হ্যাটট্রিক ও ২টি গোল করে হিসাব সমান করলেন।
আমি উপভোগ করছি সতীর্থদের সঙ্গে। বয়স যাই হোক, এখানে (আর্জেন্টিনা) এলে নিজেকে বাচ্চা ছেলেটি মনে হয়। যত দিন মনে হবে ভালো বোধ করছি, দলকে যেভাবে সাহায্য করতে চাই, সেভাবেই করতে পারছি, তত দিন উপভোগ করব।লিওনেল মেসি, বলিভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে
কিন্তু মেসি নিজে বাকিদের সমান অবস্থানে থাকতে পারলেন কোথায়! আচরণে তাঁকে কখনো কখনো বিনয়ের অবতার মনে হলেও ফুটবলে পরিসংখ্যানে সে সুযোগটাই যে নেই! এই ম্যাচেও তো নতুন ইতিহাসের জন্ম হলো। লাতিন আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে এখন তিনটি হ্যাটট্রিক মেসির। ব্রাজিলের দুই ভদ্রলোক তোস্তাও ও জিকোর পর এই মহাদেশের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দুটি হ্যাটট্রিক করা তৃতীয় খেলোয়াড়ও মেসি।
মেসি চাইলেও এখন আর সাধারণের কাতারে নেমে আসতে পারবেন না। লাওতারো মার্তিনেজ যেমন গোল করার পর আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়েছেন মেসিকে। যেন গোলটা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা, মেসির পাসটাই সব! আর মনুমেন্তালের সবুজ ঘাসে দু চোখে পেতে থাকা দর্শকেরা? ৩৩৩ দিন পর আর্জেন্টিনার মাটিতে খেলতে নেমেছিলেন মেসি। আর্জেন্টিনার ৬ গোলের ৫টিতেই তাঁর অবদান। গ্যালারিতে আবেগের ঝড়টা কেমন ছিল তা না বললেও চলে। সেই আবেগ দু-একটি ব্যানারে অনূদিত হলো এভাবেও, ২০২৬ বিশ্বকাপেও মেসিকে চাই!
What's Your Reaction?