স্বাধীন বাংলাদেশে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রথম সফর: ঘটেছিল যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিল।
এর মাত্র চার মাস পর, ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসেন, এবং এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর।
এটা স্মরণযোগ্য, কেননা ১৯৭১ সালের মার্চে যখন ভুট্টো ঢাকায় ছিলেন, তখন পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছিল। পরদিন, ২৬ মার্চ, ভুট্টো ঢাকায় ত্যাগ করেন এবং পাকিস্তান ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, "আল্লাহকে ধন্যবাদ, পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।"
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভুট্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি ১৯৭২ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তিনি পাকিস্তানকে কমনওয়েলথ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব কারণে, ভুট্টোর সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং এর সঙ্গে জড়িত নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটে।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার, তখনকার সংবাদপত্রে বর্ণনা অনুযায়ী, কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ভুট্টোকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এক বিরল দৃশ্য উপস্থাপন করেছিল। তবে সফরের সময়ে ভুট্টো বিক্ষোভের মুখেও পড়েন এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মাথার টুপি না খোলায় সমালোচিত হন।
### ২৭ জুন, ১৯৭৪: ভুট্টো ঢাকায় আগমন
পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় পৌঁছান ২৭ জুন সকালে। তাকে স্বাগত জানাতে বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। ভুট্টো বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। এরপর তাকে ফুলের মালা পরিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হয়।
গণমাধ্যমে এই অভ্যর্থনার কথা বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। দৈনিক গণকণ্ঠ ২৮ জুন তারিখে শিরোনাম দেয়, ‘ঢাকায় ভুট্টোর অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা’ এবং দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় ভুট্টোর আন্তরিক অভ্যর্থনা’।
এদিন বিমানবন্দর থেকে ভুট্টোকে বঙ্গভবনের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, পথে রাস্তার দু'পাশে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার মানুষ, কিছু মানুষ তাকে স্বাগত জানালেও, কিছু মানুষ বিক্ষোভও দেখায়।
### ২৭ জুন রাতে ভুট্টোর সম্মানে নৈশভোজ
পরদিন, ২৭ জুন রাতে ভুট্টোর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করা হয় বঙ্গভবনে, যেখানে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখেন। শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার আহ্বান জানান।
ভুট্টো তার বক্তব্যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে 'একটি নিষ্ঠুর ও লজ্জাকর অধ্যায়' হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করার কথা বলেন এবং দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন।
### ২৮ জুন: স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিক্ষোভ
ভুট্টো ২৮ জুন সকালে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তবে সেখানে ভুট্টোকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। হাজার হাজার মানুষ কালো পতাকা হাতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় উপস্থিত হয়ে তাকে 'ঘাতক' এবং 'কসাই' বলে সম্বোধন করে।
এ সময় তিনি স্মৃতিসৌধের সামনে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মাথায় টুপি না খোলায় তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়। শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই, তাকে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়।
### ২৮ জুন বিকেল: গণহত্যা নিয়ে ভুট্টোর 'তওবা'
বিকেলে ভুট্টো একটি নাগরিক সংবর্ধনায় অংশ নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ স্বাধীনতার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায় এবং আমরা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আমাদের সামরিক শাসকদের দায়ী করি।"
তবে, অনেকেই তার বক্তব্যে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তোলেন।
### ৩০ জুন: সাংবাদিকদের সঙ্গে তোপের মুখে ভুট্টো
ভুট্টো ঢাকা ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সাংবাদিকরা তার কাছে প্রশ্ন করেন, ১৯৭১ সালের গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার করা হবে কি না। ভুট্টো কিছুটা অসহায়ভাবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন এবং দাবি করেন, তিনি কখনোই সামরিক সরকারের পক্ষে ছিলেন না, এবং যেহেতু পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার প্রান্তে ছিল, তাই তাকে ওই সময় নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল।
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের "পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ" না করার অনুরোধ করেন।
### সফরের শেষ পরিণতি
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা মূলত অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য ছিল, তবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পদের বন্টন, অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা ব্যর্থ হয়।
বিভক্ত পাকিস্তানের সম্পদের ভাগ নিয়ে পাকিস্তান যৌথ কমিটির প্রস্তাব করলেও, বাংলাদেশ একমত না হওয়ায় আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি।
এভাবে, ১৯৭৪ সালের এই সফরটি ছিল এক যুগান্তকারী মুহূর্ত, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর হিসেবে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে।
**তথ্যসূত্র:** বিবিসি
What's Your Reaction?