অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে জরুরি প্রস্তাব
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সন্ধ্যায় শপথ নিলেন, সেই রাতেই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে সন্ধ্যায় শপথ নিলেন, সেই রাতেই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। আহত ব্যক্তিদের সব চিকিৎসার ব্যবস্থাই এই সরকার নেবে—এ রকম প্রতিশ্রুতি প্রথম দিন থেকেই উপদেষ্টারা বারবার দিয়েছেন।
এর মধ্যে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আহত ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়া, বিদেশ থেকে চিকিৎসক দল আনা, আহত ব্যক্তিদের বিদেশে পাঠানো, এক ছাদের নিচে সব রোগীর চিকিৎসার সুযোগ তৈরির মতো কিছু উদ্যোগ আমরা দেখেছি। শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর জন্য এককালীন অনুদানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
সরকারের উদ্যোগে ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ জন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে। তবে সরকার যা পরিকল্পনা করেছে, তা দৃশ্যমান নয়। জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো নিদারুণ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। আহত ব্যক্তিরা যে দুর্ভোগের মধ্যে আছেন এবং তাঁদের চিকিৎসা নিয়ে যেসব সমালোচনা উঠছে, তার ভিত্তিতে সরকারের সদস্য ও ছাত্র সমন্বয়কদের উদ্দেশে আমরা কয়েকটি প্রস্তাব রাখছি।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার বিষয়গুলো যে কেবলই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে, এটা একপেশে। উদাহরণ দেওয়া যাক। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর জন্য বিনা মূল্যে খাবারের বরাদ্দ থাকে। বিশেষ করে একা চলাচলে অক্ষম আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিকটাত্মীয় থাকেন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের কোনো বরাদ্দ থাকে না। যেসব রোগীর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই খরচ বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসার অতিরিক্ত এসব খরচ বহন করার কোনো সুযোগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। অথচ ঠিক এ কারণেই বহু রোগী চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে ফেরত চলে যান।
দুস্থ রোগীর সহায়তায় বড় হাসপাতালগুলোয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি ছোট অফিস এবং একজন কর্মকর্তা থাকেন। এ ধরনের রোগী খুঁজে খুঁজে বের করে সাহায্য করা তাঁদের দায়িত্ব। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এ উদ্দেশ্যে প্রতিটি হাসপাতালের জন্য কিছু বরাদ্দ থাকে। হাসপাতালে থাকা চিকিৎসার আনুষঙ্গিক খরচ বহনে অপারগ রোগীদের তালিকা তৈরি করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অফিস এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে।
নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পুনর্বাসন
আন্দোলনে আহত-নিহত ব্যক্তিদের বড় অংশই ছিলেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ উপার্জনক্ষম সদস্য। তাঁদের অনেকেরই আয়রোজগার বন্ধ। এ কারণে হাসপাতালের নানা ব্যয় বহনে তাঁরা অক্ষম। এ বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অঙ্গীকারের বিষয়। এর দায়িত্ব তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অঙ্গ হারিয়ে কিংবা শরীরে অজস্র ছররা গুলি নিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া আন্দোলনকারীদের উপার্জনসহ সমাজে টিকে থাকার জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্বটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। গণ-অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের জন্য তাদের বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে।
তবে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সহযোগিতাও প্রয়োজন হবে। প্রধান উপদেষ্টার অধীন একটি জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের পেশাগত দক্ষতা অনুযায়ী তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা নেওয়া দরকার।
আহত ব্যক্তিদের শারীরিকভাবে সুস্থ করে তুলতে ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হবে। রোগীদের বাসা থেকে প্রতিদিন এসে তা নেওয়া ব্যয়বহুল। অনেকের অন্যের সহায়তা ছাড়া যাতায়াত করাও দুরূহ। সিআরপি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের এক-চতুর্থাংশ দামে ফিজিওথেরাপি সেবা দেয়। সরকার সিআরপির সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে আহত ব্যক্তিদের বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে।
অভ্যুত্থানে হতাহত ও তাঁদের পরিবারের মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং একেবারেই আমলে নেওয়া হয়নি। যিনি অঙ্গ হারিয়েছেন, তিনি ও তাঁর পরিবারের পক্ষে তা মানসিকভাবে গ্রহণ করা দুঃসহ। নতুন পরিস্থিতিকে গ্রহণ করতে না পারার অসহনীয় অবস্থাকে পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি) বলে। আহত রোগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পেশাদারি কাউন্সেলিং না করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও মেডিকেল কলেজগুলোর মানসিক রোগ বিভাগে এমন কাউন্সেলরের সংখ্যা সীমিত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে কাউন্সেলিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যক্তিগত খাতেও এ রকম প্রতিষ্ঠান আছে। এ কাজে তাদের সমন্বিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
এবারের আন্দোলনে অনেক আন্দোলনকারী দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক এনজিও বাংলাদেশে দৃষ্টি নিয়ে কাজ করে। সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে অন্ধ হয়ে যাওয়া তরুণদের জন্য বাইরে থেকে চিকিৎসক এনে বা রোগীদের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি। এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো এসব প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করার জন্য সুপারিশ করতে পারে।
আহত ব্যক্তিদের জন্য আমরা বিভিন্ন নাগরিক উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। আন্তরিকতা সত্ত্বেও সমন্বিতভাবে কাজ করার সুযোগ তাঁরা পাচ্ছেন না। এসব উদ্যোগকে সরকারিভাবে স্বাগত জানালে এবং তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দিলে আরও অনেকে এ-জাতীয় কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ পাবেন। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বিভিন্ন ব্যাংকও আহত ব্যক্তিদের সেবায় তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা দিতে পারে।
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের নৈতিক দায়িত্ব একাধিক মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নাগরিকসহ সবাইকে নিয়ে পালন করতে হবে। মন্ত্রণালয়ের কাজে যুক্ত থাকার জন্য প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই ছাত্র প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। তাঁদের তারুণ্য ও প্রাণশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ সমন্বয়। এই সমন্বয়ের নেতৃত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই দিতে হবে; তাদের মোটেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
What's Your Reaction?