পশ্চিমকে খেপানো কি ঠিক হবে এরদোয়ানের
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক ইউরেশিয়ায় নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানোর পর থেকেই দেশটির সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক ইউরেশিয়ায় নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানোর পর থেকেই দেশটির সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
একদিকে তুরস্কের পশ্চিমাদের কাছ থেকে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দরকার; আবার অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে পূর্বের কাছে (বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের কাছে) তুরস্ক আলোচনায় থাকতে চেয়েছে।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর-পরবর্তী আঙ্কারা সম্ভবত রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
তুরস্ক হচ্ছে এমন কয়েকটি মুসলিম দেশের মধ্যে একটি, যে দেশগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে। দেশটির অবস্থান ইউরোশিয়ায়। সে কারণেই তাকে দীর্ঘদিন ধরে জনতুষ্টিবাদ, পশ্চিমা উদারনীতি, মুসলিম বিশ্ব নেতৃত্ব এবং ভূরাজনৈতিক জটিলতায় আটকে থাকতে হচ্ছে।
সম্প্রতি চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ফোরামের (ব্রিকস) সদস্য হওয়ার জন্য তুরস্ক আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অতি সম্প্রতি দেশটি এই ফোরামের সদস্য হওয়ার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো আবেদন করেছে। কয়েক মাস আগে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) বার্ষিক সম্মেলনে তুরস্ক প্রথমবার আবেদন জানিয়েছিল।
তুরস্কই ন্যাটোভুক্ত প্রথম কোনো দেশ যে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চলতি মাসে রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় ব্রিকস সম্মেলনে আঙ্কারার আবেদনটি ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করা হতে পারে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ) আঙ্কারার অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। গোড়াতে ইইউর নাম ছিল ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি)। ১৯৮৭ সালে তুরস্ক ইইসির সদস্য হওয়ার আবেদন করেছিল এবং ১৯৯৯ সালে তাকে যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেই সব আটকে আছে। এরপরে আর উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। যোগ্য ঘোষণার পরও তুরস্ককে ইইউ সদস্য করেনি।
২০২৩ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে, যেখানে বলা হয়, তুরস্ক তার পথ পরিবর্তন না করলে তাদের সদস্যপদ দেওয়ার প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে এরদোয়ান ইইউ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি দেন।
গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি মিসর, সৌদি আরব এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক সারাই করার জন্য তুরস্ক নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। আঙ্কারা যখন বুঝতে পেরেছে, বাকি বিশ্বের সঙ্গে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে হবে, তখনই সে ব্রিকসের দিকে ঝুঁকেছে।
অন্যদিকে ইইউসহ গোটা পশ্চিম কিন্তু তুরস্ককে হারানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না। এর কারণ হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউরোপের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার মধ্যে পশ্চিমাদের কাছে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেছে।
২০২৩ সালে তুরস্ক ইইউর পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে, যা কিনা বিশ্বের সঙ্গে ইইউর মোট পণ্য বাণিজ্যের ৪ দশমিক ১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানির ওপর পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর ইউরোপের কাছে তুরস্ক গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে।
ঠিক একইভাবে, আঙ্কারার ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্বও উপেক্ষা করা যায় না। পশ্চিমারা ভালো করে জানে, তুরস্ক কয়েকটি মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগস্থল হলো তুরস্ক। এ কারণে পূর্বদিকে (রাশিয়া ও চীন) তুরস্কের ঝোঁক পশ্চিমের জন্য ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক জোরালো হলে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সফল হতে পারে, যা পশ্চিমাদের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এদিকে রাশিয়া ও চীনের দোরগোড়ায় তুরস্কের অবস্থান হওয়ায় ন্যাটোতে তুরস্কের ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাটো ব্লকটি গঠিত হওয়ার তিন বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে আঙ্কারা ব্লকটিতে যোগ দেয়। তখন আঙ্কারা পশ্চিমা উচ্চাকাঙ্ক্ষার পক্ষে ছিল এবং ট্রান্স–আটলান্টিক জোটের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক তার অগ্রাধিকার পরিবর্তনের যে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, তা আঙ্কারাকে ন্যাটোর একটি অস্থির ও অবিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়ার ওপর ন্যাটো ও পশ্চিমা দেশগুলো অবরোধ আরোপ করার পরও আঙ্কারা মস্কোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়িয়ে চলেছে। মস্কোর কাছ থেকে আঙ্কারার এস-৪০০ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ক্রয় তার একটি বড় উদাহরণ।
তুরস্ক যদি ব্রিকসে শেষ পর্যন্ত যোগ দিয়েই ফেলে, তাহলে তা ন্যাটোতে আঙ্কারার অবস্থানকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। এর ফলে তুরস্ক এই ট্রান্স–আটলান্টিক জোটে তার বিশ্বস্ততা হারাতে পারে। এর ফলে তুরস্ক ন্যাটোর জন্য একটি হুমকিতে পরিণত হতে পারে।
ন্যাটো থেকে তুরস্কের সরে আসাটা ইইউতে তার অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাকে আরও ম্লান করে দেবে। এটি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদ ইস্যুতেও তুরস্ককে সংকটে ফেলতে পারে। কারণ, তুরস্ক ন্যাটো থেকে বেরিয়ে গেলে পশ্চিমের দেশগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে সমর্থন করতে পারে।
ব্রিকসে যোগদান আঙ্কারাকে কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে পারে বটে, কিন্তু ব্রিকস আঙ্কারাকে ন্যাটোর মতো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না।
আঙ্কারা ব্রিকস নামের যে ব্লকটিতে যোগ দিতে যাচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ডিডলারাইজেশন (মার্কিন ডলারভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বের হওয়া) প্রতিষ্ঠা করা। ফলে এই ব্লকে যোগদান করলে স্বাভাবিকভাবেই আঙ্কারাকে অনেক কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক মূল্য চুকাতে হবে।
-
সৈয়দ নাসির হাসান ইসলামাবাদভিত্তিক গবেষক ও লেখক।
মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
What's Your Reaction?