বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়ানোর উপায় কী
প্রথমত, উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। বিশেষ করে, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার যেখানে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, সেখানে রাষ্ট্র বেকারত্বের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি, রাষ্ট্রকে অবশ্যই উচ্চশিক্ষার সুযোগও সবার জন্য রাখতে হবে। তবে, বর্তমান পরিকাঠামোয় কিভাবে তা সম্ভব, সে বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি।
প্রথমত, উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। বিশেষ করে, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার যেখানে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, সেখানে রাষ্ট্র বেকারত্বের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি, রাষ্ট্রকে অবশ্যই উচ্চশিক্ষার সুযোগও সবার জন্য রাখতে হবে। তবে, বর্তমান পরিকাঠামোয় কিভাবে তা সম্ভব, সে বিষয়ে আলোচনা করা জরুরি।
এ বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১১টি শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ১৩ লাখ ৩১ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। পাসের হার ছিল ৭৭.৭৮ শতাংশ, অর্থাৎ ১০ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছেন। ধারণা করা যায়, তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী আর পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন না। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার আশায় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন। কিন্তু খুব কমসংখ্যক শিক্ষার্থীই তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবেন।
মেডিকেল, বুয়েট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি শুরু হয় এইচএসসি পাসের পর থেকেই। কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করে যে ভর্তি পরীক্ষা একটি কঠিন লড়াই। বাস্তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দেখতে পান, প্রতিবছর একেকটি সিটের বিপরীতে কতগুলো শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করেন। অনেক শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
এখন চিন্তা করতে হবে, আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনসংখ্যা বাড়াতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পরই উপায় ও পরিকল্পনার দিকগুলো পরিষ্কার হতে পারে।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ইউনিটের ১ হাজার ৮৫১টি আসনের জন্য ১ লাখ ২২ হাজার ৮০ জন আবেদন করেছেন। এর মানে, একটি আসনের জন্য ৬৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। গত কয়েক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়েনি, বরং বেশিরভাগ বিভাগে আসন কমেছে। এর ফলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। চার-পাঁচ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারতেন, বর্তমানে তার থেকেও কমসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হন। অন্য স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতি বছর তাদের ভর্তি সক্ষমতা যাচাই করতে হয়। অনলাইনে আবেদন শুরু হওয়ার আগে প্রতিটি বিভাগের কাছ থেকে জানানো হয়, তারা কত শিক্ষার্থী নিতে পারবে। বিভাগগুলো তাদের বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী আসনের সংখ্যা নির্ধারণ করে। তবে, কিছু বিভাগের ক্ষেত্রে যেখানে চাহিদা বেশি, সেখানে আসনের তুলনায় বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রধান আকর্ষণ, তবে স্বায়ত্তশাসিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের কঠোর প্রতিযোগিতা করতে হয়। তবে, আশ্চর্যের বিষয় হলো, যাদের কঠোর সাধনা ও চেষ্টা করে ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন।
এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কিছু পরিবর্তন দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষায় মনোযোগী হন। এছাড়া, শিক্ষার্থীদের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করার চাপ হ্রাস করতে হবে। কেননা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর পড়াশোনার খরচের বিপরীতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এক শিফটের বদলে দুই শিফট চালু করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু বিভাগ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ১০০ থেকে ১৫০ শিক্ষার্থী ক্লাস করেন। এতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক আলোচনা বা দলগত কাজের সুযোগ কম থাকে। তবে, দুটি শিফটে ক্লাস নিলে এই সমস্যা সমাধান হতে পারে।
দ্বিতীয় শিফট চালু করলে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব। তবে, এতে কিছু বাড়তি সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ। এর জন্য শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো বা তাদের অতিরিক্ত সম্মানী দেওয়া হতে পারে। এছাড়া, হলের আবাসন, পরিবহন ব্যবস্থা এবং লাইব্রেরির আসনসংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
কিছু ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া সম্ভব, যেমন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ভর্তি ফরমে উল্লেখ করতে পারবে যে তারা আবাসিক সুবিধা নেবেন না। পরিবহন ব্যবস্থার জন্য গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো, লাইব্রেরিতে শিফট ব্যবস্থা চালু করা ইত্যাদি পদক্ষেপও কার্যকর হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অর্ধেক অংশ অনলাইন ভিত্তিক করা যেতে পারে। কোভিডের সময়েই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অনলাইনে দক্ষতা অর্জন করেছেন। অনলাইনে এমন কিছু সুবিধা পাওয়া যায়, যা ক্লাসরুমে সম্ভব নয়, যেমন বইয়ের পিডিএফ কপি প্রদর্শন বা শিক্ষকের স্লাইড দেখিয়ে আলোচনা।
বর্তমানে বেশিরভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন ক্লাস হয়। তবে, যদি সপ্তাহে দুই দিন সরাসরি ক্লাস এবং দুই দিন অনলাইন ক্লাস হয়, তাহলে শিক্ষকদের চাপ কমানো যাবে। বাকি দিনটি শিক্ষার্থীদের দলগত কাজ, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, লাইব্রেরি কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি এবং ধারাবাহিক মূল্যায়নের জন্য রাখা যেতে পারে।
"উচ্চশিক্ষিত বেকার" সমস্যা কমানোর জন্য মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অন্তত অর্ধেক সংখ্যককে গবেষণার কাজে যুক্ত করতে হবে। তাদের গবেষণার বিষয় সমাজের চাহিদার দিকে মনোযোগ দিয়ে নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করতে হবে, যাতে তারা দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
মোট কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংখ্যা বাড়াতে চাইলে আগে চিন্তা করতে হবে, এরপর এর উপায় ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
— তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
What's Your Reaction?