প্রমা ইসরাত জানান, ঢাকায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কোনো সক্রিয় কমিটি নেই। দারিদ্র্য এবং মেয়েদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার অভাবের কারণেই বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। এমনকি যেসব মেয়েরা নিজেরাই বাল্যবিবাহে সম্মতি দিচ্ছে, তাদের অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ।
মিষ্টিদের বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া
কড়াইলের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা সংকীর্ণ অলিগলি পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় জামাই বাজারে মিষ্টিদের বাসায়। সরু, রেলিংবিহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই মিষ্টিদের এক কক্ষের টিনশেড ভাড়া ঘরটি। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মিষ্টি সবার ছোট। তার বাবা-মা বনানীর একটি বাসায় নিরাপত্তাকর্মী ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন।
গত শনিবার (২৬ অক্টোবর) মিষ্টির বাসায় গিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়। সে কমিউনিটি বিদ্যালয় বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বনানী সুপারমার্কেটের এক দোকানকর্মীর (১৯) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছেলেটি তাকে গাজীপুরে নিয়ে বিয়ে করে। বিয়েতে ছেলের মা-বাবা উপস্থিত থাকলেও মিষ্টির পরিবারের কেউ ছিল না।
বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের এবং ২১ বছরের নিচে ছেলেদের বিয়ে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য হবে। এই আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ সম্পাদন, পরিচালনা বা তাতে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে ১৯ ধারায় বিশেষ প্রেক্ষাপটে আদালতের নির্দেশ এবং মা-বাবা বা অভিভাবকের সম্মতিতে, অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে বাল্যবিবাহ বৈধ হতে পারে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭-এর ১৯ ধারার বিশেষ বিধান অনুসারে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে অপ্রাপ্তবয়স্কের সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ ও মা-বাবা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিতে বাল্যবিবাহ বৈধ বলে গণ্য হতে পারে।
মিষ্টির বাবার অভিযোগ, কাবিননামায় যে কাজীর নাম-ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সেই কাজী এখন মৃত। মৃত কাজীর ছেলে হৃদয় অবৈধভাবে বাবার নামে এই বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করেছেন। মিষ্টির বাবা আরও জানান, গত মাসে বনানী থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ এ বিষয়টি মীমাংসার পরামর্শ দেয়।
মিষ্টি জানায়, বিয়ের দুই মাসের মধ্যেই সে গর্ভধারণ করে। কিন্তু শাশুড়ি তাকে ট্যাবলেট খাইয়ে গর্ভপাত করান। স্বামীর মারধরেও অতিষ্ঠ হয়ে চার মাস আগে সে বাবার বাসায় ফিরে এসেছে।
মিষ্টির সহপাঠী শিউলির (ছদ্মনাম)ও বাল্যবিবাহ হয়েছে। মা-বাবার ইচ্ছাতেই বিয়ের পর সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। মিষ্টির বন্ধু ও সহপাঠীদের মধ্যে এমন আরও সাতজন বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
গত মঙ্গলবার বিদ্যাসাগর মডেল স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি শ্রেণিকক্ষে শিশুরা পড়াশোনা করছে। শিক্ষিকা শারমীন সুলতানা জানান, কখন যে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন, তা তারা জানতে পারেন না।
অষ্টম ও নবম শ্রেণির আটটি মেয়ের মধ্যে পাঁচটি মেয়ের বাল্যবিবাহ ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন স্কুলটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক মো. শাহীন মৃধা। তিনি জানান, শিক্ষার অভাব এবং সচেতনতার অভাবে কড়াইলের বাসিন্দারা বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নন।
কড়াইলে ১৪টি স্কুল রয়েছে, আর সব স্কুলেই কম-বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বিশেষত অষ্টম ও নবম শ্রেণির মেয়েদের মধ্যে এ হার বেশি। কড়াইলের সাততলা এলাকার ব্লাস্টের কিশোর-কিশোরী দলের সদস্য সাথি (ছদ্মনাম), মহাখালী মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী, তারও আগস্ট মাসে বাল্যবিবাহ হয়েছে।
বিয়ের জন্য উৎপাতের অভিযোগ
ব্লাস্টের প্যারালিগ্যাল সদস্য ও কড়াইলের বাসিন্দা হালিমা খাতুন জানান, অনেক মেয়েকে গ্রামে নিয়ে গিয়ে বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে সাততলা এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণির এক ১৩ বছর বয়সী ছাত্রীকে "ফুসলিয়ে" বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তবে তাদের প্রচেষ্টায় তা প্রতিরোধ সম্ভব হয়।
মেয়েটির বড় বোন জানান, তার ছোট বোন গ্রামে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাদের বাবা সেলুনের দোকান চালান এবং মা পোশাককর্মী হিসেবে কাজ করেন। বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে এলাকার এক ছেলেকে পরিবারের সহায়তায় তার বোনকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, "আমার বোন তো এখনও অনেক ছোট! ও এখনো মাসিকও সঠিকভাবে বুঝে না। আমরা কীভাবে ওকে বিয়ে দেব? ছেলেটিও বয়সে ছোট, ওষুধের দোকানে কাজ করে।”
বোন আরও জানান, ছেলের পরিবারের চাপের কারণে তার বোনকে এখন এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা হয়েছে। বনানী থানায় ছেলের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়েছে।