হিসাববহির্ভূত সম্পদের মালিক সাবেক আইনমন্ত্রীর এপিএস জীবন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া দুটি উপজেলা মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) হিসেবে কাজ করা রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন এবং তার হাত ধরে এলাকায় এক ধরনের সন্ত্রাসী শাসন কায়েম হয়েছিল।
**আনিসুল হকের এপিএস রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন: অবৈধ অর্থে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক**
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া দুটি উপজেলা মিলিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) হিসেবে কাজ করা রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন এবং তার হাত ধরে এলাকায় এক ধরনের সন্ত্রাসী শাসন কায়েম হয়েছিল। মাদকের কারবার, ভারতীয় গরু পাচার, টেন্ডারবাজি এবং বদলি বাণিজ্যে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার। আইনমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় কসবা ছিল তার ‘রাজ্য’, যেখানে তার সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো কিছুই চলত না।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আনিসুল হকের এপিএস হিসেবে মো. রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ দখল করেন এবং এরপর তার ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে। কসবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদও তিনি দখল করেন। এ দুই পদ ব্যবহার করে তিনি শাসনের নামে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েন। জীবন নিজেকে কসবা অঞ্চলের একক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন, যা এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত।
জীবন নয়নপুর বাজারের পাশে সরকারি খাস জায়গা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমিতে ৪৫টি দোকান নির্মাণ করেন এবং এসব দোকান থেকে ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা করে অগ্রিম আদায় করেন। এসব টাকার সিংহভাগ তার ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করা বায়েক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার চক্রবর্তীর মাধ্যমে উত্তোলন করা হত। জীবন তার ক্ষমতার দাপটে এলাকার মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে এভাবে অর্থ উপার্জন করতেন।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার ও যুবলীগ নেতা আজমলের মাধ্যমে সীমান্তের ওপারে মাদক পাচারের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন জীবন। গত ১০ বছর ধরে এই সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকার মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল এবং জীবন প্রতিমাসে ৩০ লাখ টাকা পেতেন। তিনি ভারত থেকে গরু পাচারের সাথেও যুক্ত ছিলেন। ভারতীয় সীমান্ত থেকে গরু পাচারের জন্য জীবনকে প্রতি বছর দুই কোটি টাকা দিতে হত।
এপিএস জীবন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১০ জন ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে আদায় করেছেন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে বায়েক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকেও ৫ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। জীবন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও দলের ভেতরের বিরোধীদের ভয় দেখিয়ে এলাকায় একক আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা, হুমকি, মারধরসহ নানা নির্যাতন চালানো হতো। তার ভয়ে পুরো কসবা অঞ্চলে আতঙ্ক বিরাজ করত।
জীবনের অসংখ্য অপকর্মের প্রতিবাদ করায় কসবা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেনসহ কয়েকজন নেতাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়। জীবনের একাধিক অপকর্মের সহযোগী হিসেবে বায়েক ইউনিয়নের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা পরিচিত ছিলেন, যারা এখন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
এছাড়া, জীবন কসবা রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করেন এবং অভিযোগ রয়েছে, সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে কোটি টাকার চোরাচালান পণ্য নিয়ে আসা-যাওয়া হত। তার বিরুদ্ধে ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা নিয়ে বদলি করার অভিযোগও রয়েছে।
তবে, তার এই অপরাধ ও অবৈধ সম্পদ নির্মাণের দিন শেষ হয় ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর রাতে, যখন তাকে রাজধানী ঢাকার কাকরাইল থেকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে আর বের হতে পারেননি।
এভাবে, এক সময়ের ক্ষমতাধর এই এপিএস জীবন, যার হাতে ছিল ভয়াবহ অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ, এখন নিজেই আইনশৃঙ্খলার আওতায় রয়েছেন।
What's Your Reaction?