খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ কোটি টাকা
ব্যাংক খাতে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা, ফাইন্যান্স কোম্পানিতে ২৪ হাজার ১ কোটি টাকা বেড়েছে * সরকার পতনের পর জালিয়াতির তথ্য প্রকাশিত হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে
আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশে ব্যাংক এবং ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব এবং অব্যাহত জালিয়াতির কারণে এই ঋণ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ বিতরণ করা প্রায় সমস্ত ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও ফাইন্যান্স খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ১২ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতে বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা এবং ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে বেড়েছে ২৪ হাজার ১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ব্যাংকাররা মনে করছেন, খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে, কারণ অনেক ঋণ যা খেলাপির যোগ্য ছিল, তা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। নিয়মের বেড়াজালে মিথ্যা প্রলেপ দিয়ে এসব ঋণ চাপা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এখন সেগুলি প্রকাশিত হচ্ছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তারা টানা শাসন করে, এবং এই সময়ে আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের বিপর্যয় ঘটেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এবং ২০০৯ সালের প্রথম দিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা, যা বর্তমানে বেড়ে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, অর্থাৎ ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০০৯ সালের শুরুতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৭১০ কোটি টাকা, যা জুন মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকায়, প্রায় ৩৫ গুণ বৃদ্ধি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা বড় অংশেই খেলাপি হয়ে গেছে।
সরকার পতনের পর, এসব জালিয়াতির তথ্য আরও প্রকাশিত হতে শুরু করেছে, এবং ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আরও দ্রুত বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঋণখেলাপিরা প্রায় অপ্রতিরোধ্য ছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাদের পক্ষে কাজ করেছেন, ফলে ঋণখেলাপিরা ঋণ শোধ না করেও একের পর এক ছাড় পেয়ে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, এবং ব্যাংকগুলো বর্তমানে তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে, কিছু ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুটপাটের চিত্র আরও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আগে জানা গিয়েছিল যে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, তবে এখন জানা যাচ্ছে তারা ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, এর মধ্যে ২৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হতে যাচ্ছে। অন্যান্য ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও বাড়ছে। ন্যাশনাল ব্যাংক সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ করেছে। সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকেও খেলাপি ঋণ বাড়বে।
অর্ধনীতিবিদরা মনে করছেন, ঋণের রাইটঅফ, খেলাপির যোগ্য ঋণকে খেলাপি না ঘোষণা করা, এবং আদালতের নির্দেশে ঋণ খেলাপি না করার মতো নানা কারণে অনেক ঋণ এখনও নিয়মিত রয়েছে। এসব কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।
২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় স্থিতিশীল ছিল, কিন্তু ২০১২ সালে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকায়। এরপর, ২০১3 সালে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমলেও ২০১৪ সালে তা আবার বেড়ে ৫০ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ছাড়ায়। এর পর থেকে খেলাপি ঋণ বাড়তেই থাকে এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে ৯৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায় পৌঁছায়।
২০২1 সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণ ১ লাখ কোটি টাকার বেশি হয়ে যায়। এরপর তা আর কখনো ১ লাখ কোটি টাকার নিচে নামেনি। ২০২৩ সালের জুন মাসে তা আরও বেড়ে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৭১০ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের জুনে বেড়ে ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
What's Your Reaction?