"ঢাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাতির প্রকোপ বাড়ছে, কোন এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?"

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা ভাঙা থাকায় অপরাধীদের দ্রুত শনাক্তকরণে পুলিশ সমস্যায় পড়ছে। কিন্তু এই সিসি ক্যামেরাগুলো মেরামতের কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

Nov 2, 2024 - 06:20
Nov 2, 2024 - 10:31
 0  2
"ঢাকায় ছিনতাইকারী ও ডাকাতির প্রকোপ বাড়ছে, কোন এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?"

"রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা ভাঙা থাকায় অপরাধীদের দ্রুত শনাক্তকরণে পুলিশ সমস্যায় পড়ছে। কিন্তু এই সিসি ক্যামেরাগুলো মেরামতের কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। 

মঙ্গলবার মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায়, ১০ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানে ছিনতাইকারীরা রবিউল ইসলাম নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ১৮ অক্টোবর দিনদুপুরে ইডেন কলেজের উপাধ্যক্ষ মমতাজ শাহানারার বাসায় ডাকাতি ঘটে। ৯-১০ জন ডাকাত উত্তরার ওই বাসায় প্রবেশ করে মমতাজ শাহানারাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ৮৩ ভরি স্বর্ণালংকার ও ১৫ লাখ টাকা লুটে নিয়ে যায়। 

মোহাম্মদপুর ও উত্তরার এই দুটি ঘটনা রাজধানীতে ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের অস্থিরতা বাড়ানোর উদাহরণ। একই সঙ্গে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ঢাকায় ১৯২ জন খুন হয়েছে, এর মধ্যে মোহাম্মদপুরেই ২১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। নগরের প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি, এমনকি অভিজাত এলাকায়ও ছিনতাই ও ডাকাতির শিকার হচ্ছেন মানুষ। এই পরিস্থিতিতে নগরবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদে গত শনিবার স্থানীয় বাসিন্দারা থানার সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। 

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান NTC NEWS24  বলেন, মোহাম্মদপুর বিভিন্ন কারণে রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। জনবল সংকটের কারণে পুলিশ সেখানে সঠিকভাবে টহল দিতে পারছে না।"

"ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে (অক্টোবরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত) রাজধানীতে ১৯২ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরে ২১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে ১১টি এবং অক্টোবরে ১৯টি খুনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। 

এছাড়া, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধির সূচকও রয়েছে। যদিও এই ধরনের বেশিরভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। 

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত মাসের প্রথম ২৩ দিনে রাজধানীতে ২৬টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে এবং একই সময়ে ডাকাতির মামলা হয়েছে ৪টি। সেপ্টেম্বরে ১৫টি ছিনতাই ও ৫টি ডাকাতির মামলা রেকর্ড করা হয়েছিল। 

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২৯টি মামলা দায়ের হয়েছিল, কিন্তু ডাকাতির কোনো মামলা ছিল না। ওই বছরের অক্টোবরে ২৮টি ছিনতাইয়ের মামলা ও ৩টি ডাকাতির মামলা রেকর্ড করা হয়েছিল। 

মোহাম্মদপুর অঞ্চলটি নানা কারণে রাজধানীর অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। জনবল সংকটের কারণে পুলিশ সেখানে সঠিকভাবে টহল দিতে পারছে না, বলেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান।"

"পুলিশ, ভুক্তভোগী ও হাসপাতাল সূত্র জানাচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে পুলিশি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও, হঠাৎ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যায়। ছিনতাইকারী ও ডাকাতের কবলে পড়ে মানুষ আহত হলে কিংবা থানায় মামলা দায়ের করলে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু অনেকেই বাড়তি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে থানায় যেতে চায় না।

এর ফলে থানায় ছিনতাই ও ডাকাতির যে পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ হয়, তা প্রকৃত ঘটনার তুলনায় অনেক কম। কখনও কখনও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো দেখাতে থানার পুলিশ মামলা গ্রহণে গড়িমসি করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক সময় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার নজিরও দেখা যায় ছিনতাইয়ের ঘটনায়।"

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে (অক্টোবরের ২৩ তারিখ পর্যন্ত) রাজধানীতে ১৯২ জন খুন হয়েছেন। শুধু মোহাম্মদপুরেই ২১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে খুনের ঘটনা ছিল ১১টি, অক্টোবরে ১৯টি।

ছিনতাইকারীর হাতে নিহত

গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার কুতুবখালীতে রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা।

এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন মুস্তাকিম আলিফ (২৫) নামের এক তরুণ। ১৬ সেপ্টেম্বর সকালে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় বেড়িবাঁধে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন দিনমজুর আলমগীর ব্যাপারী।

৩ সেপ্টেম্বর কদমতলীর মেরাজনগরে ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাতে খুন করে কাঁচামাল বিক্রেতা হাশেমকে। একই দিন ভোরে হাজারীবাগের সিকদার মেডিকেলের পাশে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারীরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক সাদেকিনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

"নওগাঁ থেকে জাররাফ আহমেদ নামে এক যুবক ২৭ আগস্ট ভোরে ঢাকায় এসে দারুস সালাম এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ হারান।

সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ডাকাতির ঘটনায় অন্যতম হলো ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসা ও কার্যালয়ে ডাকাতি। সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের পোশাক পরা ডাকাতেরা নিজেদের যৌথ বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুটে নিয়ে যায়। তবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এই ঘটনায় জড়িত অনেককে দ্রুত শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়।"

"পুলিশের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকার মহানগর পুলিশের মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। বর্তমানে ঢাকার থানাগুলোতে পুলিশের বড় একটি অংশ ঢাকার বাইরের পুলিশ সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, যারা রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি এখনও সঠিকভাবে চেনে না। এর পাশাপাশি, রাজধানীতে তাদের তথ্যদাতার একটি নেটওয়ার্কও গড়ে ওঠেনি।

পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানোর কারণে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা হয়। অনেক থানা ভবন এবং পুলিশের টহল যান পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ফলে সপ্তাহ খানেক ধরে থানায় পুলিশ ছিল না। পরে পুলিশ ফিরলেও যানবাহন ও জনবল সংকটের কারণে টহল কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করা সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, এবং কিছু এলাকায় নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের কেউ কেউ ডাকাতিতে জড়িত হওয়ারও উদাহরণ পাওয়া গেছে।

এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ভুক্তভোগীদের থানায় যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান। তিনি গত বুধবার প্রথম আলোকে জানান, ছিনতাই ও ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশকে টহল দেওয়ার জন্য ৩০০টি মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছে। আগের দিকে পুড়িয়ে দেওয়া ডিএমপির গাড়িগুলোও মেরামত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ ও র‍্যাব দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং যৌথ বাহিনী সেখানে অভিযান পরিচালনা করছে। কিছু ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং বাকিদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলমান। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমানও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।"

প্রতিবাদের পর অভিযান
মোহাম্মদপুরে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও সংঘর্ষের মতো ঘটনার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে স্থানীয় বাসিন্দারা গত শনিবার সন্ত্রাসমুক্ত মোহাম্মদপুরের দাবিতে থানার সামনে প্রতিবাদ করেন। এর পরই ওই দিন রাতেই সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‍্যাব যৌথ অভিযান শুরু করে। গত শুক্রবার পর্যন্ত ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।

এদিকে, মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও ঢাকার অন্যান্য এলাকার পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। গত বুধবার দুপুরে পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় মাদকের কারবার নিয়ে বিরোধের জের ধরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আয়েশা আক্তার (২৮) নামে এক নারী নিহত হন। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলের অদূরে দোতলা একটি বাড়ির জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই নারীর শরীরে লাগে।

বিশেষ অভিযান জোরদারের নির্দেশ
সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক, কিশোর গ্যাং, এবং ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে চলমান বিশেষ অভিযানকে জোরদার করতে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছেন। গত সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনার কথা জানানো হয়।

জানতে চাইলে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। যৌথ বাহিনী সেখানে অভিযান পরিচালনা করছে এবং কিছু ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পুরো ঢাকা শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow