প্রতিদিন ১৫ কোটির বেশি মানুষ প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করছে
বাংলাদেশে প্রায় ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ (১৫ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার) প্রতিদিন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করে। শহরে সাধারণত পানির বোতল এবং গ্রামে কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস)-এর বোতল হিসেবে এর ব্যবহার বেশি।
বাংলাদেশে প্রায় ৮৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ (১৫ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার) প্রতিদিন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করে। শহরে সাধারণত পানির বোতল এবং গ্রামে কোমল পানীয় (সফট ড্রিংকস)-এর বোতল হিসেবে এর ব্যবহার বেশি। তবে, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল থেকে নির্গত রাসায়নিক পদার্থ, বিশেষ করে বিসফেনল এ (বিপিএ), শরীরের হরমোন সিস্টেমে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা, এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
‘একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত প্রভাব: দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে বেসরকারি সংস্থা ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)।’
গবেষণায় জানানো হয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে তথ্য সংগ্রহ ও জরিপ পরিচালনা করা হয়। গবেষকদের মতে, একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার বর্তমানে একটি ভয়াবহ বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে, এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহারে নালা বন্ধ হয়ে যাওয়া, রাসায়নিক উপাদান মিশ্রিত জলপথ এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
পলিথিন টেরেফথ্যালেট (পিইটি) দিয়ে তৈরি এসব প্লাস্টিক বোতল প্রায় ৪৫০ বছর পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় থাকে। ধীরে ধীরে এগুলো ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তরিত হয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত করে, যা খাদ্যশৃঙ্খলে (ফুড চেইন) প্রবেশ করে মানুষের স্বাস্থ্যকে হুমকির মধ্যে ফেলে। বৈশ্বিকভাবে প্লাস্টিক বোতলের মাত্র ২৫ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়, বাকি ৭৫ শতাংশ নদী, মহাসাগর এবং বনভূমিতে জমে পরিবেশদূষণ সৃষ্টি করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩ দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতল ব্যবহৃত হয়, যার মধ্যে মাত্র ২১ দশমিক ৪ শতাংশ রিসাইকেল (প্রক্রিয়াজাত) করা হয়। বাকি ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্লাস্টিক বোতল নদী, সমুদ্র এবং ডাম্পিং স্টেশনে জমা হয়ে পরিবেশ দূষিত করছে।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, শহরে মাত্র ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং গ্রামে মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন। প্রায় ৫১ শতাংশ শহরের ভোক্তা এবং ৪২ শতাংশ গ্রামীণ ভোক্তা এই প্লাস্টিক বোতলগুলো একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেন। এছাড়া, প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বর্জ্য সংগ্রহকারীদের মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ এই বোতলের পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে সচেতন।
এসডোর চেয়ারম্যান সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, "প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য বোতল থেকে সৃষ্ট দূষণ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থা উন্নত করা এবং প্রতিবেশতন্ত্র রক্ষায় সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবুল হাশেম বলেন, "একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের পরিবেশগত এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না। বিসফেনল এ (বিপিএ) এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের মতো রাসায়নিক আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে, যা মানব স্বাস্থ্য এবং জীববৈচিত্র্যের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।"
এসডোর মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন বলেন, "বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন, যাতে টেকসই বিকল্প এবং দায়িত্বশীল ভোক্তা আচরণ উৎসাহিত করা যায়।"
এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, "একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের সংকট মোকাবিলায় সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা প্রতিটি স্তরে পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেছি, যাতে পরিবেশবান্ধব সমাধান গ্রহণ, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের সহায়তা এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষায় কঠোর নীতি প্রয়োগ করা যায়।"
গবেষণায় একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বোতলের প্রভাব কমাতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে, যেমন- পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং সাশ্রয়ী বিকল্প ব্যবহার করা, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বোতলের ব্যবহার উৎসাহিত করা, উৎপাদন ও ব্যবহার কমানো, একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি ও নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকা প্রণয়ন করা, বিকল্প সমাধান প্রচার করা এবং পরিবেশসম্মত রিসাইকেল নিশ্চিত করা।
What's Your Reaction?