পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের বর্ণনা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেন বদলায়?

নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কিত বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের পরিবর্তন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

Jan 5, 2025 - 05:34
 0  0
পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের বর্ণনা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কেন বদলায়?

নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস সম্পর্কিত বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের পরিবর্তন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এই পরিবর্তিত পাঠ্যসূচি নিয়ে শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বিশেষভাবে, ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনায় যে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে, তা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারের ঘোষণা দেয়। এর অংশ হিসেবে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে পাঠ্যবইগুলো পরিমার্জন করেছে। নতুন বইগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার ঘোষণাসহ নানা বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। 

বিশেষত, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। নতুন বইয়ে স্থান পেয়েছে জুলাই-অগাস্ট আন্দোলন এবং কিছু নতুন গল্প-কবিতা। বইয়ের প্রথম অংশ থেকে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতও বাদ দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার বাণী বাদ দিয়ে জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি যুক্ত করা হয়েছে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান এই পরিবর্তনগুলির কারণ হিসেবে ইতিহাসের অবদানগুলো নির্মোহভাবে তুলে ধরার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন নেতার অবদানকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করা হয়েছে, এবং পাঠ্যপুস্তককে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য সঠিক ইতিহাসের উপস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছিল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু পরিবর্তনের যে প্রবণতা রয়েছে, সেটি নতুন নয়। ১৯৭৭ সালে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে ২০১২ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর শিক্ষাক্রমে আটবার পরিবর্তন হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একটি বড় কারণ। এনসিটিবির চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসান বলেন, "আগের বইগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে অতিরিক্ত উপস্থাপন ছিল, যা এবার বাদ দেওয়া হয়েছে। তার অবদান, যেটুকু তা প্রাসঙ্গিক, সেটুকু উল্লেখ করা হয়েছে।"

মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে নতুন বইয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার অবদান উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, বিষয়টির রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান বলেন, "পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের অধ্যায়ে সব পক্ষের কথা থাকা উচিত, তবে ইতিহাসের বিরোধীদের, যেমন রাজাকার, আল বদর, আল শামসদেরও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন।"

প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হয়েছে। এসব পরিবর্তন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বিভাজন এবং ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। শিক্ষক, অভিভাবক এবং প্রশাসনের মধ্যে একটি নিরপেক্ষ শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা, যাতে ইতিহাসের সঠিক ও অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা যায় এবং বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow